
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রামটির ইতিকথা 
একই পৃথিবীর মানুষ হয়েও আমরা একটি স্বতন্ত্র দেশের, স্বতন্ত্র জেলার, সর্বশেষে একটা স্বতন্ত্র গ্রামের। আমরা প্রতিটা মানুষই নিজ নিজে গ্রামকে ভীষণ ভালোবাসি, যারা শহরবাসী তারা ভালোবাসি নিজেদের মহল্লা। কেমন হতো যদি আমার গ্রামটিই হতো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম!
ঠিক এমন একটা অনুভূতিই কিন্তু বয়ে বেড়াচ্ছে অস্ট্রিয়াবাসী কিছু মানুষ। কারণ তাদের গ্রামটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম যার নাম হলস্ট্যাট। গ্রামটি সম্পর্কে বিস্তারিত বলার আগে, চলুন অস্ট্রিয়া দেশটি সম্পর্কে কিছুটা জেনে নিই।

মধ্য ইউরোপের আল্পস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত এক অপূর্ব প্রাকৃতিক নৈসর্গিক দেশ এই অস্ট্রিয়া। ৮৩,৮৫৫ বর্গ কিলোমিটার এবং প্রায় ৮৯ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এই দেশটি ইউরোপের অন্যতম ছোট একটি দেশ যার ৬০ ভাগই জুড়ে আছে আল্পস পর্বতমালা। আর দক্ষিণ থেকে পূর্বে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার পথে বয়ে চলছে ঐতিহাসিক দানিউব নদী।
স্বভাবতই সারা বছরই দেশটিতে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। আল্পস পর্বতমালার সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন অনেকেই। আবার গ্রীষ্মে বরফ গলে গেলে, আশ্চর্যজনক সৌন্দর্য নিয়ে জেগে ওঠে ইউরোপের অন্যতম পুরনো একটি গ্রাম হলস্ট্যাট যেটি বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জনপদ। গ্রামটি উত্তর অস্ট্রিয়ার সালসকামারগুট আপার অস্ট্রিয়ার (Oberösterreich) রাজ্যের গেমুন্ডেন জেলার একটি ছোট গ্রাম।
অস্ট্রিয়ার ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮৪৬ সাল থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত এই এলাকায় খনন কার্য চালিয়েছিল সে সময়ের একদল প্রত্নতাত্ত্বিক। তাদের এই খননের পর এখানে আবিষ্কৃত হয়েছিল ইউরোপের এক অজানা সভ্যতা ও সংস্কৃতি। জানা যায় যে আল্পস পর্বতমালার প্রত্যন্তে লুকিয়ে থাকা এই এলাকাটিতেই ব্রোঞ্জ যুগের সমাপ্তি ও লৌহ যুগের সূত্রপাত ঘটেছিল।
তাই, ব্রোঞ্জ ও প্রাথমিক লৌহ যুগের সংস্কৃতির নাম হলস্ট্যাট সংস্কৃতি।মধ্য ইউরোপে বিস্তার করা এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ হয়েছিল এই হলস্ট্যাট গ্রাম থেকেই।

এখান থেকেই ছেড়ে যায় হলস্ট্যাট যাওয়ার বোট। দুদিক ঘিরে আছে পাহাড়, আর তাদের মাঝখান দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে ৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হ্রদটি। লেকের ওপারেই বিস্ময়কর গ্রাম হলস্ট্যাট।

হলস্ট্যাট ভিলেজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বেশ পুরনো, প্রায় ৩৫০০ বছর। ভিলেজে যেতে হলে ভিয়েনা-সালসবার্গ লাইনের ট্রেনে উঠে নামতে হবে Attnang-Puchheim স্টেশননে। অতঃপর সেখান থেকে Bad Ischl-Obertraun লাইনের ট্রেন ধরে হলস্ট্যাট স্টেশনে। Hallstättersee হ্রদের পূর্ব তীরে এই স্টেশন। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ঢালু রাস্তা দিয়ে নেমে একটু এগিয়ে গেলে হ্রদের ধার।

পাহাড়ের ধাপে ধাপে এই গ্রামের বাড়িগুলো ‘বারোক’ শৈলির আঙ্গিকে গড়ে তোলা হয়েছে । এখানকার প্রতিটি বাড়ি, ক্যাফে, দোকান, রেস্তোরাঁগুলো সর্বদা সাজিয়ে রাখা হয় সবুজ অর্কিড আর নানা রঙের মৌসুমি ফুলে। এমন দৃশ্য দেখলে আপনার মনে হতেই পারে সেগুলো যেন একেকটা ফুলেরই দোকান।
হ্রদের পাড় থেকে আঁকাবাঁকা গলি পথ উঠে গেছে পাহাড়ের উপর। রাস্তার দুই পাশে শত শত বছরের পুরাতন বাড়িঘর কিন্ত এতটাই সুন্দর অবস্থায় সাজিয়ে রাখা হয়, দেখে মনে হবে বাড়িগুলি সম্প্রতি তৈরি করা হয়েছে।
সবশেষে বলতে হয় শুধুমাত্র অর্থ-বিত্ত থাকলেই আস্ত একটা পাহাড়ি গ্রামকে ছবির মত সাজিয়ে রাখা যায় না।তার জন্য প্রয়োজন বাসিন্দাদের উন্নতমানের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গিও। সেদিক থেকে হলস্ট্যাটের বাদিন্দারা নিঃসন্দেহে তাদের সফলতা দেখিয়েছে।
হলস্ট্যাট যেন সৌন্দর্যের একটি গোপন রহস্য। তাই পর্যটকেরা পাহাড়ের যত উঁচুতে উঠে ততই রূপসী হয়ে উঠে হলস্ট্যাট গ্রামটি।

আজ গ্রামটির আকর্ষণ এতটাই দুর্দান্ত যে আরেক দেশ চীনে প্রায় হলস্ট্যাটের আদলেই চীনারা নিঁখুত করে বানিয়েছে বাড়ি এবং একটি গির্জা সহ হলস্ট্যাটের একটি পূর্ণ আকারের প্রতিরূপ। চীনের নকল হলস্ট্যাট গ্রামটি বানিয়েছে মিনমেটালস নামে চীনের এক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান। আর এই নকল হলস্ট্যাট গ্রামটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে ৯৪০ মিলিয়ন ডলার!
১৯৯৭ সালে হলস্ট্যাট এবং ডাশ্চটেইন সালসকামার্গাট অঞ্চলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলে ঘোষণা করে UNESCO. তারপর থেকে যেন পর্যটকদের ঢল নেমেছে এই কয়েকশো লোকের গ্রামটিতে। অস্ট্রিয়ার অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ আজ এই হলস্ট্যাট পরিণত হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম হিসেবে।